নাগরিক কবি শামসুর রাহমান --- মুশফিক বরাত
June 19, 2021 at 7:27 pm,
No comments
শামসুর রাহমানের কবিতায় নগরনিসর্গ, বৃষ্টিমুখর রাত্রি, জনপদ, পুরোনো দালান, ফুটপাত, গলি-ঘুপচি, ফল, পাখি ইত্যাদি ফুটে উঠে অমায়িক সৌন্দর্যে। স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের স্ফটিক জলে তিনি নিয়ত অবগাহন করেন। প্রকৃতপক্ষে তার কবিতা স্বপ্নময় ও সৌন্দর্যখচিত তেমনি আত্মমগ্ন। তার কবিতা হয়েছে বহুমুখী ও বৈচিত্র্যময়; অপার নৈপূণ্যে ও কুশলতায় ভরপুর। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো হলো ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, ‘রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘বন্দি শিবির থেকে’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’- ইত্যাদি।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান। কোলকাতা ও বাংলাদেশ উভয় বাংলায় তিনি সমান জনপ্রিয়। তার সাহিত্যকর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করার পূর্বে ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে কিছু বলা যাক। ১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই শামসুর রাহমান জোহরা বেগমকে বিয়ে করেন। কবির তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। তাদের নাম সুমায়রা আমিন, ফাইয়ারা রাহমান, ফাওজিয়া সাবেরিন, ওয়াহিদুর রাহমান মতিন ও শেবা রাহমান।
রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে যে পাঁচ আধুনিক কবি- সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ ও অমিয় চক্রবর্তী- বাংলা কবিতায় ভিন্নধারা তৈরি করেছিলেন তাদের বাইরে দাঁড়িয়ে নগরকেন্দ্রিক কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন শামসুর রাহমান। আধুনিক কবিদের উত্তরসূরি; আক্ষরিক অর্থে বাংলা সাহিত্যের নাগরিক কবি। যে কারণে তাকে সফল নাগরিক কবি বলা হচ্ছে সেই শহরটির নাম ঢাকা। আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকা- আমাদের বাঙালীদের স্পর্শকাতর অনুভূতির ঢাকা। যে কোনো প্রয়োজনে যেখানে যেতেই হয়। এই ঢাকার অধিবাসী শামসুর রাহমান বাংলা কাব্যে নাগরিকতার ধারক।
তার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলো- প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৫৯)। নাগরিক জীবনের কান্তি, ব্যর্থতা, বস্তি-গ্রাম-নগরের মিশ্র জনপদ ইত্যাদি ফুটে উঠেছে তার এই কাব্যগ্রন্থের অনেক স্তবকে। শামসুর রাহমানের লেখা আমার প্রিয় কবিতাগুলো হলো- ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ এগুলো। আরেকটি কবিতা যেটা আমাকে এখনো আলোড়িত করে- ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’। তার কবিতায় বিদ্যমান নগরকেন্দ্রিকতা কারো চোখ এড়িয়ে যায় না। প্রকৃতি-নিসর্গ-নন্দনের বরপুত্র নন, বরং কন্টকিত নগর সভ্যতার প্রতিচ্ছবি। তিনি আজীবন ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। তার প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে জীবনানন্দের ছায়া আছে। তবুও তিনি জীবনানন্দ থেকে অনেক স্বতন্ত্র। শিক্ষা-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমস্ত দিক থেকে তিনি জীবনানন্দ থেকে আলাদা।
জীবনানন্দের ভালোবাসা ও ঘৃণা দুটোই ছিল চরম- অন্যদিকে একজন নাগরিক কবি হিশেবে তিনি স্থিতধী অনেক সময় নিরাসক্ত। স্কুল-কলেজের নানা অনুষ্ঠানে এখনো আবৃত্তি হতে শোনা যায় তার এ কবিতাটি- ‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা।’
এই কবি জন্মগ্রহণ করেন ২৩ অক্টোবর ১৯২৯ ও মৃত্যুবরণ করেন ১৭ আগস্ট ২০০৬। ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
জীবনে সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন অনেক। ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘স্বাধীনতা পদক’, ‘আনন্দ পুরস্কার’ ইত্যাদি। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি কাজের সৌন্দর্যের দ্যুতিকে মানবকল্যাণের যুক্তিবাদিতার পথে নিয়োজিত করেছেন, ছিলেন অসাম্প্রদায়িক-সমাজতান্ত্রিক। যেমন ছিলেন লেনিনের ভক্ত তেমনি মাওলানা ভাসানীর উপর শ্রদ্ধাশীল। এই স্বপ্নচারী কবি স্বপ্নের জগতে নিয়ত বিচরণ করেও বাস্তবের কঠিন পথ বিস্মৃত হননি; দ্রোহ ও প্রতিবাদের যোগ্য ভাষা দিয়েছেন।